ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে বিকাশ-নগদ ও উপায়সহ মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে অর্থপাচার চক্রের মাস্টারমাইন্ডরা। গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে তিনটি হুন্ডিচক্রের ১৬ জনকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি গ্রেপ্তার করলেও হোতারা এখনও অধরা। এ ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে দায়ের হওয়া তিনটি মামলার এজাহারনামীয় ৪৫ আসামির মধ্যে ওই ১৬ জন ছাড়া আর কেউ ধরা পড়েনি। তবে বাকি আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে সিআইডি।
ওই ১৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পায় সিআইডি। ধারণা পায় জড়িত অন্যদের সম্পর্কেও। অর্থপচারের অভিযোগ ওঠে বিকাশ, নগদ ও উপায়সহ কয়েকটি এমএফএস এজেন্টের বিরুদ্ধে। এরপর ওই এজেন্টদের লাইসেন্স বাতিল করেই দায়সারা দায়িত্ব শেষ করে ওইসব এমএফএস কোম্পানি। তবে সিআইডি বলছে, কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা এই অর্থপাচারে জড়িত কিনা তা নিশ্চিত হতে তদন্ত চলছে। জড়িত অন্যদের শনাক্ত কার্যক্রমও চলছে বলে জানান সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবির গতকাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তদন্ত থেমে নেই। মাস্টারমাইন্ডদের শনাক্তে কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ওই তিন মামলার এজাহারনামীয় বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। শর্টটাইমের মধ্যেই একটি ভালো ফল পাওয়া যাবে।’
ওই সিআইডি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘চক্রে সংশ্লিষ্ট অন্যদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। যা তদন্ত ত্বরান্বিত করারই অংশ। কেউ তদন্ত থামাতে পারবে না। তদন্ত নিজস্ব গতিতে চলছে, চলবে। আমরা নজরদারি অব্যাহত রেখেছি। জড়িত অন্যদের এবং তাদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তারা কাদের সাথে যোগাযোগ রাখছে, তাও নজরে রাখা হয়েছে।’ এদিকে সিআইডির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থপাচারকারী আরও ৪টি বড় হুন্ডি চক্রের সন্ধান মিলেছে। চক্রগুলো হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে বলে সিআইডি প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে তাদের কড়া নজরে রাখা হয়েছে। তারা সিআইডির জালে বললেই চলে।’
অভিযান চালাতে বিলম্ব হওয়ার বিষয়ে সিআইডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের অভিযান চালাতে সিআইডি প্রধানের অনুমতি লাগে। কিন্তু সিআইডি প্রধান দেশের বাইরে থাকায় অভিযান চালানো হয়নি। এখন তিনি দেশে ফিরেছেন। অভিযান সংক্রান্ত অনুমতি চাওয়া হয়েছে সিআইডি প্রধানের কাছে। দু-এক দিনের মধ্যেই ওই চার চক্রকে গ্রেপ্তারে করা হবে। তারা সিআইডির হাতের মুঠোয় বললেই চলে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বর মাসে চালানো ওই অভিযানের পর রেমিট্যান্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) প্রবাহ বৃদ্ধি পেলেও ফের তা কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২১ শতাংশ। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, অভিযানের পর মোবাইল সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থপাচারকারী হুন্ডি চক্র গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিলেও, তারা ফের মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে। বেপরোয়া গতিতে চলছে অর্থপাচার। সিআইডির অভিযানে ভাটা পড়ায় অর্থপাচার ফের বেড়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে ওই ১৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদে চক্রে জড়িত অন্যদের সম্পর্কেও ধারণা পায় সিআইডি। বলা হয়, বিকাশ-নগদসহ ওই সব প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজারের বেশি এজেন্ট সন্দেহজনক লেনদেনে জড়িত। সংশ্লিষ্টদের এজেন্টশিপ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বাতিল করা হলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি।
এ বিষয়ে সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) রাজিবুল হাসান গতকাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মোবাইল ফিনান্সিয়াল মাধ্যমে অর্থপাচার ঠেকাতে সিআইডির সাইবার মনিটরিং সেন্টার থেকে ২৪ ঘন্টা নজরদারি করা হচ্ছে।’
রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়টি সিআইডি বিশ্লেষণ করছে জানিয়ে ওই সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যেসব সন্দেহজনক লেনদেন পাচ্ছি, এর পেছনে কারা তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
বিকাশ-নগদকেন্দ্রিক হুন্ডিচক্রের ঢাকা ও চট্টগ্রামে যে তিনটি মামলা রয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা ওইসব কোম্পানিগুলোর কাছে যেসব তথ্য চেয়েছি। তা তারা দিচ্ছে। তারা সহযোগিতা করছে। শিগগিরই চক্রের বাকিরা গ্রেপ্তার হবে।’
গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক অভিযান চালিয়ে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট। পরদিন সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, গত এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়সহ বিভিন্ন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে চক্রটি বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল হুন্ডি কারবার করে আসছে। দেশে ডলারের দাম বাড়াসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কারণ তদন্ত করতে গিয়ে একাধিক হুন্ডি চক্রের তথ্য মিলে। এসব চক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি।
সিআইডি প্রধান আরও বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের মাধ্যমে ৫ হাজার এজেন্ট ৪ মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করে। বছরে এই পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা।’ তিনি বলেন, ‘যে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ৪ মাসে ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া এমএফএসের মাধ্যমে হুন্ডি করে এমন ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি।’
সিআইডি প্রধান বলেন, ‘সংঘবদ্ধ এই হুন্ডিচক্র তিনটে গ্রুপ হয়ে এই কাজটি করে থাকে। সারাদেশে তিনটি গ্রুপের পাঁচ হাজার এমএফএস এজেন্টের হুন্ডি ব্যবসায়ী সক্রিয় রয়েছে। শুধু চলতি বছরের গত চার মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকা সমপরিমাণ মূল্যের রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ।প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে তথ্য সংগ্রহ করে দেশে থাকা যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপ পাচারকারী ও তার সহযোগীরা দেশীয় মুদ্রায় এমএফএস এজেন্টদের কাছে পাঠায়। পরে তৃতীয় গ্রুপ বিদেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এমএমএস নাম্বারে দেশীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে।’
সিআইডি প্রধান বলেন, ‘অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায়, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধমে বিদেশে অর্থপাচার এবং বিদেশে অবস্থানরত ওয়েজ আর্নারদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করে আসছে।’
এছাড়া এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে বলেও জানান সিআইডি প্রধান।
গ্রেপ্তার ১৬ জন হচ্ছে- আক্তার হোসেন, দিদারুল আলম সুমন, খোরশেদ আলম ইমন, শামীমা আক্তার, বিকাশ এজেন্ট রুমন কান্তি দাস জয়, আবদুল বাছির, মাহাবুবুর রহমান সেলিম, আবদুল আউয়াল সোহাগ, ফজলে রাব্বি, বিকাশ ডিএসএস হোসাইনুল কবির, নবীন উল্লাহ, জুনাইদুল হক, আদিবুর রহমান, আসিফ নেওয়াজ, ফরহাদ হোসাইন ও রাশেদ মঞ্জুর ফিরোজ।এসময় তাদের কাছ থেকে নগদ ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা, চারটি সিমে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ২২৯ জব্দ ইলেকট্রনিক টাকা, ৩৪টি মোবাইল, ৩টা ল্যাপটপ, একটি ট্যাব, ৩৩টি সিম, একটি হার্ডডিক্স, ৭টি মডেম ও ১০টি চেক বই।
এদিকে এই ঘটনায় এ ঘটনায় মানিলন্ডারিং আইনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার মামলায় এদের ১১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ওই মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ২৩ জন। এখনও গ্রেপ্তার হয়নি ১২ জন।
আরেকটি মামলা করা হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায়। মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ১০ জন। গ্রেপ্তার ১৬ জনের ২ জনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকি ৮ জন এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে। এছাড়া এ ঘটনায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে রাজধানীর খিলগাঁও মডেল থানায় একটি মামলা করে সিআইডি। গ্রেপ্তার ১৬ জনের ৩ জনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকি ১৩ আসামি এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। সবমিলিয়ে এজাহারনামীয় ৪৫ আসামির মধ্যে ২৯ জন গ্রেপ্তার হয়নি।
এ বিষয়ে মামলার ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) হুমায়ূন কবির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ওইসব আসামিদের গ্রেপ্তারে সিআইডি তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে আরও যাদের নাম আসছে, তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
সুত্র: ঢাকা টাইমস